ফাতিমি খিলাফত ও আইয়্যুবী বংশ (৯০৯-১২৫০ খ্রি:)

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (পুরোনো সংস্করণ) - ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ১ম পত্র | | NCTB BOOK

ফাতিমি খিলাফত ও আইয়্যূবী বংশ (৯০৯-১২৫০ খ্রি.)

ভূমিকা

শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখা ঈসমাইলীয়রা হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতিমার (রা.) বংশধর দাবী করে ৯০৯ সালে উত্তর আফ্রিকায় ফাতিমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে। ঈসমাইলীয়রা ছিল সপ্তম ইমামে বিশ্বাসী বা সাবিয়া (The Seveners)। তারা প্রথম সাত জন ইমামকে তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে স্বীকার করে। উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠার পর পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী ধরে গৌরবের সাথে এর যাত্রা অব্যাহত থাকে। শেষ দিকের খলিফাগণ বিশেষ করে আল-হাকিমের পরবর্তী খলিফাগণ ছিলেন অযোগ্য, অদক্ষ, অকর্মণ্য এবং তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন নাবালক । ফলে আল-হাকিমের মৃত্যুর পর প্রকৃত ক্ষমতা উযিরদের হাতে চলে যায় এবং নাবালক উত্তরাধিকারীগণ তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। ১১৭১ সালে সর্বশেষ খলিফা আল-আদিদের মৃত্যু হলে সালাহ্উদ্দিন আব্বাসীয়দের অনুকূলে আইয়্যূবী বংশ প্রতিষ্ঠার করেন এবং এর মধ্য দিয়ে ২৬২ বছরের ফাতিমি শাসনের অবসান হয়।

এই ইউনিটের পাঠসমূহ

পাঠ-১০.১ : ফাতিমিদের পরিচয় ও খিলাফত প্রতিষ্ঠা পাঠ-

১০.২ : উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী, আল-কায়িম ও আল-মনসুর

পাঠ-১০.৩ : আল-মুইয

পাঠ-১০.৪ : আল- আযিয

পাঠ-১০.৫ : আল-হাকিম পাঠ-১০.৬ : ফাতিমিদের পতন

পাঠ-১০.৭ : জ্ঞান-বিজ্ঞানে ফাতিমিদের আবদান

পাঠ-১০.৮ : ক্রুসেড

পাঠ-১০.৯ আইয়ূবী বংশ


 

ওপেন স্কুল

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ১ম পত্র

প্রচারের প্রধান কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এখান থেকে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচারের জন্য প্রচারক প্রেরণ করেন এবং এই মতবাদের সমর্থকদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। ঈসমাইলীয়রা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে গোপন আস্তানা গড়ে তুলে ইমামের পক্ষে প্রচারণা চালায়। প্রচারকরা পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এর ফলে ইয়েমেন, বাহরাইন, ভারত (সিন্ধু), মিসর এবং উত্তর আফ্রিকার অনেক মানুষ এ মতবাদে দীক্ষিত হয়।

আবদুল্লাহ্ বিন মায়মুন ও আবু আবদুল্লাহ্ আল-হুসাইনের প্রচারণা : আবদুল্লাহ্ বিন মায়মুন ছিলেন পারস্যের (বর্তমান ইরান) অধিবাসী ও ঈসমাইলীয় মতবাদের প্রধান প্রচারক বা দাঈ। তিনি বিভিন্ন এলাকায় তাঁর সহকারী দাঈদের নিযুক্ত করেন। আবদুল্লাহ্ বিন মায়মুনের শিষ্য এবং দাঈ আবু আবদুল্লাহ্ আল-হুসাইনকে ইয়ামেনের প্রচারক হিসেবে পাঠানো হয়। আবু আবদুল্লাহ্ আল-হুসাইন ইয়ামেনে ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে যথেষ্ঠ প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করেন। আবদুল্লাহ্ বিন মায়মুনের মৃত্যুর পর নবম শতকের শেষ দিকে আবু আবদুল্লাহ্ আল-হুসাইন ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।

আবু আবদুল্লাহ্ উত্তর আফ্রিকায় আগমন ও ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচার : আবু আবদুল্লাহ্ আল-হুসাইন ছিলেন ইয়েমেনের সানার অধিবাসী। তিনি এক সময় আব্বাসীয়দের অধীনে বসরার মুত্তাসিব ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আশ্- শিয়ী নামে পরিচিত হন। তিনি ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচারের জন্য সুদূর উত্তর আফ্রিকাকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি কয়েকটি কারণে উত্তর আফ্রিকাকে বেছে নেন: ক. আব্বাসীয়দের রাজধানী বাগদাদ হতে এর দূরত্ব, খ. সেখানে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, গ. বার্বারদের সাম্প্রদায়িক ও আরব-বিদ্বেষী মনোবৃত্তি, ঘ. সেখানে আঘলাবী শাসনে সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইত্যাদি। আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী উত্তর আফ্রিকার এ বাস্তব অবস্থার সদ্ব্যবহার করেন। ৯০১ সালে উত্তর আফ্রিকা হতে আগত হজ্জ্বযাত্রীদের সাথে উত্তর আফ্রিকায় গমন করেন এবং সেখানে ব্যাপক সংখ্যক বার্বার জনসাধারণকে ফাতিমি মতবাদে দীক্ষিত করতে সক্ষম হন। বিশেষ করে কাতামা (কিতামা/কুতামা) নামক একটি বার্বার গোত্রের মধ্যে ঈসমাইলীয় মতবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

আঘলাবীদের পরাজয় ও ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠা : উত্তর আফ্রিকার আঘলাবীরা ছিল সুন্নি মতাবলম্বী। আঘলাবী শাসক ঈসমাইলীয়দের আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আবু আবদুল্লাহ্ দুই লক্ষ বার্বার সৈন্য প্রস্তুত করলেন। তিনি আঘলাবীদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার জন্য শীঘ্রই একজন মাহ্দী বা উদ্ধারকারীর আবির্ভাবের কথা তাদের বোঝালেন এবং ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন। এ সময় আঘলাবী শাসক ইব্রাহিম বিন মুহম্মদের মৃত্যুর পর তৃতীয় যিয়াদাতুল্লাহ্ ক্ষমতায় আসেন। তিনি ঈসমাইলীয়দের বিরুদ্ধে দুটি সেনাদল প্রেরণ করেন। আবু আবদুল্লাহ্ তাদের পরাজিত করেন। এরপর আবু আবদুল্লাহ্ তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে আঘলাবী রাজধানী রাক্কাদায় গমন করেন এবং আঘলাবীদের পরাজিত করে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন। ৯০৯ সালে আবু আবদুল্লাহ্ উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহদীর পক্ষে ক্ষমতা গ্রহণ করেন ।

উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীর আগমন ও খলিফা উপাধি গ্রহণ : মুহম্মদ আল-হাবীব তাঁর পুত্র উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীকে ইমামতের উত্তরাধিকারী নিয়োগ করে যান এবং সালামিয়ায় মৃত্যুবরণ করার পর উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী তাঁর স্থলাভিসিক্ত হন। মৃত্যুর সময় পুত্র উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, “তুমিই মাহ্দী। আমার মৃত্যুর পর তোমাকে দূরদেশে যাত্রা করতে হবে। তুমি অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমিই জয়ী হবে।” মুহম্মদ আল-হাবিবের মৃত্যুর পর আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী উবায়দুল্লাহকে উত্তর আফ্রিকায় আসার জন্য চিঠি লেখেন। তিনি তাঁকে জানান যে তিনি সেখানে তাঁর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। বেশিরভাগ বার্বার ইতোমধ্যেই ঈসমাইলীয় মতবাদে দীক্ষিত হয়েছে। তাই তিনি এখানে এসে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য তাঁকে আহবান জানান। আবু আবদুল্লাহ্ আশ্- শিয়ীর পত্র পেয়ে তিনি পুত্র কাসিম, আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ীর ভাই আবুল আব্বাস এবং কয়েকজন অনুসারীসহ বণিকবেশে উত্তর আফ্রিকায় যাত্রা করেন। আব্বাসীয় খলিফা মুক্তাফী (৯০২-৭) এই সংবাদ পেয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। তারা বিনা বাধায় ত্রিপলী পর্যন্ত পৌঁছেন। এরপর আবুল আব্বাস দল থেকে আলাদা হয়ে কায়রোওয়ানের দিকে যাত্রা করেন। সেখানে আঘলাবী কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিচয় পেয়ে কারারুদ্ধ করে। অন্যদিকে উবায়দুল্লাহ্ ও তাঁর দল পশ্চিম দিকে যাত্রা করেন। সিজিলমাসাহ (মরক্কোর অদূরে) নামক স্থানে উবায়দুল্লাহ্ ও তাঁর পুত্র ধৃত ও কারারুদ্ধ হন। এই ক্ষুদ্র রাজ্যটির শাসক ছিলেন এলিসা বিন মিদরার। আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী এই সংবাদ শুনে প্রথমে কায়রোওয়ানের দিকে যাত্রা করেন এবং ভাই আবুল আব্বাসকে মুক্ত করেন। এরপর সিজিলমাসাহর শাসক এলিসা

 

 


বিন মিদরারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাঁকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এরপর ওবায়দুল্লাহকে কারামুক্ত করেন। আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী ওবায়দুল্লাহকে সঙ্গে করে রাক্কাদায় গমন করেন এবং জনসমক্ষে তাঁকে ‘মাহ্দী' উপাধি দিয়ে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। জনগণও তাঁকে শাসক ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে স্বীকার করে এবং তাঁর নিকট আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। এভাবে ৯০৯ সালে উত্তর আফ্রিকায় ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বংশের মোট ১৪ জন খলিফা শাসন করেন।
সারসংক্ষেপ:
ফাতিমিরা হল হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতিমার (রা.) বংশধর এবং সপ্তম ইমামে বিশ্বাসী। তারা ঈসমাইলীয় সম্প্রদায় নামেও পরিচিত। এই মতবাদের প্রধান প্রচারক বা দাঈ আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী ৯০১ সালে উত্তর আফ্রিকায় আগমন করে ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচার করেন। বার্বার সৈন্যদের সহায়তায় তিনি আঘলাবীদের পরাজিত করে উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীর পক্ষে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী রাক্কাদায় আগমন করেন এবং ‘খলিফা” উপাধি গ্রহণ করেন। এভাবে ৯০৯ সালে উত্তর আফ্রিকায় ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়
 


পাঠ-১০.২
উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী, আল-কায়িম ও আল-মনসুর
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী কর্তৃক ফাতিমি বংশ সুদৃঢ়করণের বর্ণনা দিতে পারবেন। বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন ও রাজ্য বিস্তারের বিবরণ দিতে পারবেন।
আল-কায়িম ও আল-মনসুর সম্পর্কে বলতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
আল-মাহ্দীয়া, রুস্তামী, অরুবা বিন ইউসুফ, তাহরাত, ওরান, ইদ্রিসীয় রাজ্য, কাদু, আবু ইয়াজিদ ও আল-মানসুরিয়া
উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী (৯০৯-৯৩৪):
উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী ৯০৯ সালে উত্তর আফ্রিকায় ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি নিজেকে একজন যোগ্য শাসক হিসেবে প্রমাণ করেন এবং সমগ্র ইফ্রিকিয়ার উপর ফাতিমি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ীকে হত্যা : সিংহাসন লাভ করার দুই বছর পর তিনি আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ীকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হত্যা করেন। উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীকে কারামুক্ত করার পর আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী ভেবেছিলেন যে উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী শুধু একজন আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড তাঁর উপর ছেড়ে দেবেন। কিন্তু উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী একইসাথে ধর্মীয় নেতা ও শাসক হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে গ্রহণ করেন। এতে আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী ও তার ভাই আবুল আব্বাস ক্ষুব্ধ হন। ফলে তারা উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীকে ক্ষমতাচ্যূত করার জন্য কিছু সংখ্যক বার্বার নেতার সাথে ষড়যন্ত্র করেন। উবায়দুল্লাহ্ আল- মাহ্দী এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে আবু আবদুল্লাহ্ আশ্-শিয়ী ও তাঁর ভাই আবুল আব্বাসকে হত্যা করেন।
আল-মাহ্দীয়া নগরী স্থাপন : উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী তাঁর বংশের নিরাপত্তা ও একটি সুশৃংখল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে
তোলার লক্ষ্যে একটি সুরক্ষিত নতুন রাজধানী স্থাপন করেন এবং এর নাম দেন ‘মাহ্দীয়া’। এটি কায়রোওয়ান নগরী থেকে ১৬ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে তিউনিসের উপকূলে অবস্থিত। এই শহর নির্মাণ করতে মোট সময় লেগেছিল ৫ বছর। ৯১৬ সালে এই শহরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ৯২০ সালের দিকে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। শহরটি ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। এর চারদিক শক্ত দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত ছিল এবং এই দেয়ালে ছিল লোহার দরজা। শহরের অভ্যন্তরে মার্বেল পাথরে নির্মিত প্রাসাদ, পানি সরবরাহের জন্য বিরাট ট্যাংক এবং মাটির নীচে শস্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হয়। এ ধরনের একটি পরিকল্পিত রাজধানী ফাতিমিদের ভবিষ্যত স্থায়িত্বের জন্য সহায়ক হয়।
বিদ্রোহ দমন ও রাজ্য বিস্তার : খলিফা উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী ক্ষমতা গ্রহণ করার পরপরই তাঁর রাজ্যের সীমা বৃদ্ধিতে তৎপর ছিলেন। ৯০৯ সালে তিনি কাতামা নেতা অরুবা বিন ইউসুফকে পাঠিয়ে রুস্তামীদের রাজধানী তাহরাত এবং ওরান জয় করে নেন। ৯২২ সালে অরুবা মরক্কোর ইদ্রিসীয়দের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং তাদের পরাস্ত করে মরক্কোর একটি বড় অংশ ফাতিমি রাজ্যভুক্ত করেন। এর ফলে আল-মাহ্দীর রাজ্যসীমা মিসর থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তিনি একটি নৌ-বাহিনী গঠন করেন এবং ইতালীর উপকূলে অভিযান চালান। এছাড়া সার্দিনিয়া, বেলারিক দ্বীপপুঞ্জ, মালটা ও করসিকাতেও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কায়রোওয়ানে কাতামারা বিদ্রোহী হলে আল-মাহ্দী পুত্র আবুল কাসিমকে পাঠিয়ে তাদের বিদ্রোহ দমন করেন। ত্রিপলিতে আরব এবং বার্বারদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয়। জল ও স্থল পথে যৌথ আক্রমণের পর ত্রিপোলির বিদ্রোহীরা বশ্যতা স্বীকার করে ।

 


সিসিলির কর্তৃত্ব হাতছাড়া : উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী সিসিলি দ্বীপকে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি কাতামা গো হতে একজনকে নতুন গভর্নর হিসেবে সিসিলিতে পাঠান। কিন্তু পরে সেখানেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। সেখানে যিয়াদাতুল্লাহ্ পুত্র আহম্মদকে সিসিলিবাসী ক্ষমতা গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমে তিনি এই আহবান প্রত্যাখান করেন। কিন্তু পুনরায় আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সিসিলির আমীর হতে রাযী হন। এখানকার আমীর নিযুক্ত হয়ে তিনি এক চিঠি মারফত আব্বাসীয় খলিফার আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তাঁকে সিসিলির আমীর হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান। ফলে সিসিলিতে ফাতিমিদের আধিপত্য হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তা পুনরায় আব্বাসীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
মিসর অভিযান : উত্তর অফ্রিরায় বার্বারদের ক্রমাগত বিদ্রোহ এবং সেখানে উমাইয়াদের তৎপরতার কারণে উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী পূর্বদিকে রাজ্য সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি দুবার মিসর অভিযান চালান। সেনাপতি আবুল কাসিম স্থল পথে মিসরের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। আর একজন সেনাপতি খুবাসা নৌপথে বার্কা জয় করে আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। পরে বাগদাদ থেকে প্রেরিত বাহিনী ও মিসরীয় বাহিনীর মোকাবিলায় উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীর বাহিনী পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। প্রথম অভিযান সফল না হওয়ায় তিনি আবার মিসরে অভিযান প্রেরণ করেন। ৮৫টি যুদ্ধ জাহাজসহ তাঁর সেনা ও নৌ-বাহিনী মাহ্দীয়া থেকে মিসর যাত্রা করে। তাঁর বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছলে বাগদাদের খলিফা মাত্র ২৫টি জাহাজ ও কিছু সংখ্যক সৈন্য পাঠিয়ে এই বাহিনীর মোকাবিলা করেন। এই যুদ্ধজাহাজগুলো গ্রিক নৌ-সেনা দ্বারা সুসজ্জিত ছিল যারা নৌ-যুদ্ধে অত্যন্ত অভিজ্ঞ ছিল। ফলে দ্বিতীয় অভিযানেও উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীর পরাজয় ঘটে।
স্পেনের উমাইয়াদের সাথে সম্পর্ক : উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী স্পেনে ফাতিমি মতবাদ প্রচারের লক্ষ্যে একদল দক্ষ গুপ্তচর ও প্রচারক প্রেরণ করেন। তারা অতি গোপনে ফাতিমি মতবাদ প্রচার করতে থাকে। এছাড়া তিনি স্পেনে তাঁর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উমাইয়াদের অভ্যন্তরীণ শত্রু উমর বিন হানের সাথেও মিত্রতা স্থাপন করেন। এ অবস্থা অবগত হয়ে স্পেনের উমাইয়া খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমান উত্তর আফ্রিকার নেতৃস্থানীয় বার্বার জানাতা গোত্র, শিয়া ইদ্রিসীয় এবং ইবাদিয়া খারিজি নেতাদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ফাতিমিদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। প্রত্যুত্তরে উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীও স্পেন অভিযানের একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই ৯৩৪ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটে
খলিফা উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী ২৬ বছর শাসন করেন। অনেক বাধা মোকাবিলা করে তিনি ইসলামী বিশ্বে প্রথম ঈসমাইলীয় বা ফাতিমি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এটা ছিল ইসলামী বিশ্বের একমাত্র শিয়া খিলাফত। তিনি মরক্কো হতে মিসর পর্যন্ত যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন এর উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে তা আরও পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হয় এবং ১১৭১ সাল পর্যন্ত টিকে থাকতে সক্ষম হয়।
আল-কায়িম (৯৩৪-৪৬)
উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীর মৃত্যুর পর তাঁর মনোনয়নক্রমে বড় পুত্র আবুল কাসিম ‘আল-কায়িম’ উপাধি নিয়ে ৯৩৪ সালে শাসনভার লাভ করেন। তিনি তাঁর পিতার শাসনামলে সমরবিদ হিসেবে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দেন। পিতার শাসনামলে তাঁর সেনাপতিত্বে মিসরে দুবার অভিযান প্রেরিত হয়। এছাড়া উত্তর আফ্রিকার অসংখ্য বিদ্রোহ দমন করে তিনি সামরিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। খলিফা হিসেবে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ৯৩৪ সালে ফ্রান্স ও ইতালীর দক্ষিণ উপকূলে একটি নৌ-অভিযান প্রেরণ করেন। এ অভিযানে জেনোয়া এবং লোম্বার্ডির অংশবিশেষ ফাতিমিদের অধিকারে আসে। ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি তৃতীয়বারের মত মিসর অভিযান চালান। এবারও এই অভিযান ব্যর্থ হয় এবং ফাতিমি অভিযানকারীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ মিসর হতে প্রত্যাবর্তন করে। তাঁর সময় জানাতা গোত্রের ইবাদিয়া খারিজি নেতা আবু ইয়াজিদ দক্ষিণ তিউনিসিয়ায় বিদ্রোহ করে। তিনি আবু হিমার (গাধার বাপ / The man with an ass) নামে পরিচিত ছিলেন। কায়রোওয়ানের সুন্নী নেতারা এবং স্পেনের উমাইয়া খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমান তাঁকে সমর্থন করেন। আল- কায়িম তাঁকে দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু পুরোপুরি সফল হবার পূর্বেই ৯৪৬ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
আল-মনসুর (৯৪৬-৫৩) আল-কায়িমের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আবু তাহির ঈসমাইল ‘আল-মনসুর’ উপাধি ধারণ করে তৃতীয় ফাতিমি খলিফা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকালের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় আবু ইয়াজিদের বিদ্রোহ ও অন্যান্য বিদ্রোহ দমন করে রাজ্য সুদৃঢ়করণে। ৯৪৭ সালে খারিজি নেতা আবু ইয়াজিদ তাঁর কাছে পরাজিত হন এবং তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। এর ফলে ইফ্রিকিয়ায় ফাতিমি আধিপত্য পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯৪৮ সালে কায়রোওয়ানের নিকটবর্তী স্থানে তিনি একটি শহর নির্মাণ করেন যা প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত ছিল। নিজের নাম অনুসারে এর নাম দেওয়া হয় ‘আল-মানসুরিয়া’।
 


পাঠ-১০.৩
আল-মুইয
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
আল-মুইযের বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন, রাজ্য বিস্তার ও বহিঃশক্তির সাথে সম্পর্ক আলোচনা করতে পারবেন;
আল-মুইযের মিসর বিজয়ের বিবরণ দিতে পারবেন ও কায়রো নগরী প্রতিষ্ঠার বর্ণনা দিতে পারবেন ।
মুখ্য শব্দ
জওহর আল-সিকিল্লি, সিসিলি, ক্রীট, পালেরমো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়,
কায়রো নগরী, রাজা জর্জ, কারামাতিয় ও হাফ্‌তাকিন
৯৫৩ সালে আল-মনসুরের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র আবু তামিম মা’আদ ‘আল-মুইয লি-দীনিল্লাহ্' উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে ফাতিমিরা এক নব যুগে পদার্পণ করে।
জওহর আল-সিকিল্লির ভূমিকা : আল-মুইযের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার পেছনে সেনাপতি জওহরের ভূমিকা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর পূর্ণনাম জওহর আল-সিকিল্লি বা জওহর আল-রুমী বা আবু হাসান জওহার বিন আবদুল্লাহ্ । তাঁর জন্ম বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সিসিলিতে। তিনি একজন গ্রিক লিপিকার ছিলেন। সিসিলি থেকে তাঁকে ক্রীতদাস হিসেবে আল- মনসুরের সময় কায়রোওয়ানে নিয়ে আসা হয়। পরে নিজ যোগ্যতাবলে সচিব ও সেনাপতির পদে সমাসীন হন।
আল-মারিবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : শাসন ক্ষমতা লাভ করার পর তিনি প্রথমে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা বা আল-মারিবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেন। এ লক্ষ্যে তিনি সেনা ও নৌ-বাহিনীর পুনর্গঠন সম্পন্ন করেন। সেনাপতি জওহর সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় ফাতিমি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ৯৫৮ সালে ফাতিমি সেনাবাহিনী পশ্চিমে আটলান্টিক পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং সেখান থেকে জওহর উপহার হিসেবে আল-মুইযকে পাত্রের মধ্যে জীবন্ত মাছ পাঠান।
স্পেনের সাথে সংঘাত : আল-মুইয স্পেনের উমাইয়া মিত্রদের উত্তর আফ্রিকা হতে বিতাড়িত করেন। জওহর উমাইয়াদের নিকট থেকে মৌরিতানিয়া পুনরুদ্ধার করেন। ৯৫৫ সালে আল-মুইযের একটি বাণিজ্য জাহাজ উমাইয়া খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমানের (৯১২-৬১) একটি বাণিজ্য জাহাজ দ্বারা আক্রান্ত হয়। জবাবে আল-মুইয সিসিলির শাসনকর্তা হাসান বিন আলীর মাধ্যমে স্পেনের উপকূল আক্রমণ করে অনেক স্পেনীয় জাহাজ দখল করেন। প্রত্যুত্তরে খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমানও যথাক্রমে গালিব ও আহম্মদ বিন ইয়ালার নেতৃত্বে আফ্রিকার উপকূলে দুবার অভিযান চালান। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকামের সময় (৯৬১-৭৬) উমাইয়া ও ফাতিমিদের মধ্যে উত্তর আফ্রিকার আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ হয়। ৯৭৩ সালে ফাতিমি রাজধানী কায়রোতে স্থানান্তরিত হলে এ এলাকায় তাদের আধিপত্য হ্রাস পেতে থাকে ।
ক্রীটে বিপর্যয় : তাঁর সময়ের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হল ক্রীট হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। আব্বাসীয় ও ফাতিমিদের অধীনে ক্রীট সভ্যতা, শিল্প ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী হয়। ৯৬১-৬২ সালে বাইজানটাইনগণ এটা পুনরাধিকার করে মুসলিমদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালায়। পুরুষদের শরীরে আলকাতরা মেখে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। মহিলা ও শিশুদের উপরেও ভীষণ অত্যাচার করা হয় ।
সিসিলি বিজয় : ক্রীট হাতছাড়া হয়ে গেলেও সিসিলি বিজয়ের মধ্য দিয়ে এর আংশিক ক্ষতিপূরণ হয় । সিসিলির কয়েকটি সুরক্ষিত দুর্গ দিয়ে বাইজানটাইনরা আরবদের হয়রানী করত। রাজপ্রতিনিধি আহম্মদ বিন হাসান বাইজানটাইন নিয়ন্ত্রিত শহরগুলো দখল করেন। ৯৬৬ সালে সিসিলি পুরোপুরিভাবে ফাতিমি শাসনাধীনে আসে। মুসলিম শাসনামলে সিসিলি খুবই উন্নত ও সমৃদ্ধ ছিল । সিসিলির পালেরমো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বাগদাদ ও কর্ডোভার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমকক্ষ ছিল ।

 

 


মিসর বিজয় : ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে মিসর বিজয়ের লালিত স্বপ্ন আল-মুইয বাস্তবে পরিণত করেন। এর আগে উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দীর সময় দুবার ও আল-কায়িমের সময় একবার মিসরে অভিযান প্রেরণ করা হলেও নানা কারণে তা ব্যর্থ হয়। আল-মুইযের সময় মিসরের পারিপার্শ্বিক আনুকূল্য তাঁর মিসর বিজয়ে সহায়ক হয়েছিল। এ সময় মিসরে আব্বাসীয় অনুগত ইশিদীয়দের শাসন চলছিল। তাদের অধীনে এ সময়ে মিসরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, প্লেগ রোগের মহামারী, ব্যাপক মানুষের মৃত্যু, জনসংখ্যা ঘাটতি, কৃষি ও কর ব্যবস্থার অধঃপতন ইত্যাদি নানা কারণে এক চরম বিশৃংখলার সৃষ্টি হয় যার কারণে আল-মুইযের মিসর বিজয় সহজতর হয়। আল-মুইয মিসর অভিযানের দায়িত্ব দেন সেনাপতি জওহরের উপর। জওহর আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে ফুস্তাতের দিকে অগ্রসর হন এবং নদী পার হয়ে ফুস্তাত দখল করেন। ফুস্তাত দখল করার পর জওহর নাগরিক, কর্মকর্তা ও সভাসদদের অভিবাদন গ্রহণপূর্বক বিজয়ীবেশে শহরে প্রবেশ করেন। ৯৬৯ সালে মিসর ফাতিমিদের অধীনে আসে।
কায়রো নগরী প্রতিষ্ঠা : আল-মুইযই হলেন আধুনিক কায়রো নগরীর নির্মাতা। মিসর বিজয়ের পর জওহর ফুস্তাতের নিকটে কায়রো নগরীর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। আল-মুইয পূর্ব থেকেই এই নতুন শহরের নক্শা ঠিক করে দেন। ১২০০ গজের একটি বর্গক্ষেত্র চিহ্নিত করে চারদিকে খুঁটির সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঘন্টা ঝুঁলিয়ে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল শুভ সময়ের জন্য অপেক্ষা করা এবং ঘন্টা বাজিয়ে একসাথে কাজ শুরু করা। মজুররা কোদাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সংকেত প্রাপ্তির জন্য। জ্যোত্যিষরা শুভলক্ষণের সংকেত প্রাপ্তির পূর্বেই একটি কাক রশিতে বসলে সকল ঘন্টা একসাথে বেজে ওঠে ও শ্রমিকরা কোদাল দিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। এ সময়টি ছিল অত্যন্ত অশুভ। কারণ এ সময় মঙ্গল গ্রহ উদিত হচ্ছিল । মঙ্গল গ্রহকে আরবীতে বলা হয় 'আল-কাহির'। এ কারণে এ নগরীর নামকরণ করা হয় ‘আল-কাহিরা আল-মারুসা' (মঙ্গলের প্রহরাধীন নগরী) যার পরিবর্তিত নাম কায়রো। ৯৭২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এটি বর্তমানে আফ্রিকার সবচেয়ে বৃহৎ ও জনবহুল নগরী। এটাকে বাজারের শহরও বলা হয়।
দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা : মিসর বিজয়ের পূর্ব থেকেই সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। জওহর এ অবস্থা আল-মুইযকে জানালে তিনি কতগুলো জাহাজ ভর্তি করে সেখানে শস্য পাঠান এবং সেগুলো ত্রাণ হিসেবে জনগণের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা হয়। এছাড়া পণ্য গুদামজাত ও চড়ামূল্যে বিক্রি যাতে না হয় সেজন্য মুত্তাসিবের মাধ্যমে বাযার ব্যবস্থা তদারক করা হয়। তার এসব উদ্যোগের ফলে দুর্ভিক্ষ দূর হয়।
নুবিয়ার রাজার সাথে মিত্রতা : জওহর ৯৭২ সালে নুবিয়ার রাজা জর্জ-এর নিকট ইসলাম-ধর্ম গ্রহণ ও কর প্রদানের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। এই প্রতিনিধি দল সাদরে গৃহীত হয় এবং রাজা কর দিতে স্বীকৃত হন। তবে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। এই মিত্রতার ফলে নুবিয়াসহ লোহিত সাগরে ফাতিমি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে ।
কারামাতিয়দের দমন : জওহর জাফর বিন ফিল্লাহ্র মাধ্যমে দামেস্ক জয় করলে কারামাতিয়দের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে। কারামাতিয় নেতা হাসান বিন আহম্মদ হামানিয়দের সাহায্যে দামেস্ক উদ্ধার করেন এবং পরে মিসর আক্রমণ করেন। জওহর আইনুস্ শামস্ (হেলিওপোলিস) নামক স্থানে তাদের পরাজিত করেন।
কায়রোতে রাজধানী স্থাপন : কারামাতিয়দের পুনরায় মিসর আক্রমণের প্রস্তুতি ও জওহরের আমন্ত্রণের প্রেক্ষিতে আল- মুইয ৯৭৩ সালে মিসরে আগমন করেন। এরপর তিনি কায়রো নগরীকে ফাতিমিদের নতুন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন।
হাস্তাকিনের সাথে সংঘর্ষ : হাফ্‌তাকিন নামক একজন পলাতক বুয়াইয়া সেনাপতি দামেস্ক দখল করে কারামতিয়দের
সাহায্যে সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি দখল করতে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বেই আল-মুইযের মৃত্যু হয়।
ল-মুইযের অর্থনৈতিক সংস্কার : আল-মুইয মিসরে একটি শক্তিশালী ফাতিমি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ইয়াকুব বিন কিল্লিসের পরামর্শে তিনি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেন। তাঁর পরামর্শে নতুন কর ব্যবস্থা চালু হয়। নতুন নতুন পণ্য করের আওতাধীনে আনা হয়। এর ফলে মিসরের রাজস্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় যা পরবর্তীতে মিসরের ফাতিমি সাম্রাজ্য সুরক্ষা ও সম্প্রসারণে সহায়ক হয়েছিল।
 

 


আল-মুইয নিজেকে সাহসী, যোগ্য ও দক্ষ শাসক হিসেবে প্রমাণ করেন। তবে পূর্বসূরীরা তাঁর মত মার্জিত, রুচিসম্পন্ন ও উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না। তিনি আরবি, বার্বার, সুদানী, গ্রিক ও স্লাভ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর শাসনকাল ফাতিমি ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে ফাতিমিদের শ্রেষ্ঠ শাসকে পরিণত হন। তিনি এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন।
সারসংক্ষেপ :
আল-মুইযের ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে ফাতিমিরা এক নব যুগে পদার্পণ করে। তিনি আল-মারিবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সিসিলি ও মিসর বিজয় করেন। মিসর বিজয়ের পর কায়রো নগরী প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৯৭৩ সালে তিনি কায়রোতে ফাতিমিদের নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর শাসনকাল ফাতিমি ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। তিনি ছিলেন ফাতিমিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শাসক । তিনি এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন।

 

 


পাঠ-১০.৪
আল-আযিয
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
আল-আযিযের সিরিয়া বিজয় ও তুর্কী দেহরক্ষী বাহিনী গঠন সম্পর্ক আলোচনা করতে পারবেন; খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যান্যদের সাথে উদার ব্যবহারের বর্ণনা দিতে পারবেন ও
ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচার, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্থাপত্য শিল্পে অবদান আলোচনা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
হাসান বিন আহম্মদ, তুর্কী দেহরক্ষী বাহিনী, ইয়াকুব বিন কিল্লিস, ইসা বিন নেসতুরিয়াস, মুহম্মদ বিন নুমান, আল-আযহার, সোনালী প্রাসাদ ও মুক্তাভবন
৯৭৫ সালে আল-মুইযের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আল-ইমাম নিজার আবু মনসুর ‘আল-আযিয বিল্লাহ' (৯৭৫-
৯৬) নাম নিয়ে ২০ বছর বয়সে ক্ষমতাসীন হন । সাধারণভাবে তিনি ‘আল-আযিয’ নামেই পরিচিত।
সিরিয়া বিজয় : আল-মুইয সিরিয়া বিজয় কাজটি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। আল-আযিয ক্ষমতা গ্রহণ করে সিরিয়া বিজয়ের পরিকল্পনা করেন। হাস্তাকিন ও তাঁর তুর্কী বাহিনী ইতোমধ্যে দামেস্ক থেকে ফাতিমি শাসককে উৎখাত করে এবং কারামাতিয়রা তার সােেথ যোগ দেয়। রামলা, দামেস্ক ও আসকালানে হাস্তাকিন ও কারামাতিয় নেতা হাসান বিন আহমদের সাথে ফাতিমি সেনাপতি জওহরের মোকাবিলা হয়। রামলায় যুদ্ধে হাসান বিন আহমদের মৃত্যু হয়। অনেক সংঘর্ষের পর হাস্তাকিনও পরাজিত ও ধৃত হন এবং আল-আযিযের নিকট তাঁকে হাযির করা হয়। এর ফলে সিরিয়া ফাতিমি শাসনাধীনে আসে।
তুর্কী দেহরক্ষী বাহিনী গঠন : জওহর সিরিয়া বিজয় করে হাস্তাকিনকে মিসরে খলিফার সামনে উপস্থিত করলে খলিফা তাঁর সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করেন। তাঁকে মূল্যবান পোশাক, উপহার ও সুন্দর বাসভবন প্রদান করা হয়। তাঁর সাথে আনীত বন্দী তুর্কিদের নিয়ে একটি তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়। এই বাহিনীর নেতৃত্ব হাস্তাকিনের উপর ন্যস্ত করা হয়। বার্বার বাহিনীর সাথে ভারসাম্য রক্ষার জন্য সময় ও সুযোগ মত খলিফা এই বাহিনী ব্যবহার করতেন।
ইয়াকুব বিন কিল্লিসকে কারারুদ্ধ ও সম্মান প্রদর্শন : ইয়াকুব বিন কিল্লিস ছিলেন খলিফা আল-আযিযের উযির। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রশাসন চালালেও হাফ্‌তাকিনকে বিষপ্রয়োগে হত্যায় জড়িত থাকায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় । অবশ্য ৪০ দিন পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে উযির পদে পুনর্বহাল করা হয়। কারণ খলিফা তাঁর দীর্ঘদিনের সেবার কথা ভুলতে পারেননি। ইবনে কিল্লিসের মৃত্যুর পর তাঁর শবযাত্রায় খলিফা স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। তাঁর মৃতদেহ একটি সুরম্য সমাধি ভবনে রাখা হয়। তিন দিন পর্যন্ত তিনি দর্শনার্থী বা আপ্যায়ন টেবিলে কাউকে সাক্ষাৎ দেননি। ১৮ দিন সরকারি কাজ বন্ধ ছিল। এক মাসব্যাপি রাজকীয় খরচে দিনরাত তাঁর সমাধিতে প্রশংসাগাঁথা আবৃত্তি ও কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। যিয়ারতকারীদের জন্য ক্রীতদাসীরা রুপার পেয়ালা ও চামচ নিয়ে তৈরী থাকত মদ ও মিষ্টান্ন নিয়ে। মৃত উযিরের সকল ক্রীতদাসকে মুক্তি দেয়া হয়। খলিফা তাঁর সকল দেনা পরিশোধ করে দেন ।
খ্রিস্টান ও ইহুদিদের প্রতি উদারতা : তাঁর একজন স্ত্রী ছিলেন খ্রিস্টান এবং তার স্ত্রীর দুই ভাই দরবারে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। সে কারণে মিসরের কিত্তি খ্রিস্টানদের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি খ্রিস্টানদের জরাজীর্ণ গির্জাগুলির সংস্কার করেন। প্রশাসনের উচ্চপদে সর্বদা ইহুদি-খ্রিস্টানরাই বহাল ছিল। খ্রিস্টান ঈসা বিন নেসতুরিয়াস দরবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং ইবনে কিল্লিসের মৃত্যুর পর পরবর্তী দুবছর তিনি আল-আযিয়ের উযির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া ইহুদি ঈসা বিন মানিসমাও ছিলেন প্রবল ক্ষমতার অধিকারী।


ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচার : তাঁর কাজী মুহম্মদ বিন নুমানকে ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচারের জন্য বিভিন্ন যায়গায় দাঈ বা প্রচারকদের প্রেরণ করেন। ইয়ামেনে আবদুল্লাহ্ বিন বিশরকে এবং ভারতের মুলতানে জালাম বিন শাইবানকে ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচারের জন্য পাঠানো হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা : P. K. Hitti (গ্রন্থ: History of the Arabs) বলেন, “সকল ফাতিমি খলিফার মধ্যে আল- আযিয সম্ভবত সবচেয়ে বিজ্ঞ ও এবং উদার ছিলেন।” ফাতিমিদের মধ্যে জ্ঞানের প্রথম এবং উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আল-আযিযের উযির ইয়াকুব বিন কিল্লিস। তিনি একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে প্রতি মাসে ১ হাজার দিনার খরচ করা হত। খলিফা আল-আযিয নিজে একজন কবি এবং বিদ্যেৎসাহী ছিলেন। তিনি আল-আযহার মসজিদকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজপ্রাসাদে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। যাতে ২ লক্ষ গ্রন্থ ছিল। সেখানে ছিল ব্যাখ্যাসহ কুরআনের বিভিন্ন গ্রন্থ। ইবনে মুকলা এবং অন্যান্য বিখ্যাত লিপিকাররা পাণ্ডুলিপি লিখতেন। আল- আযিয এই লাইব্রেরির জন্য তাবারীর স্বাক্ষরিত তাঁর ইতিহাস বইয়ের একটি কপি সংগ্রহ করেন।
স্থাপত্য শিল্প : ৯৯০ সালে আল-আযিয একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন এবং ১০১২ সালে আল-হাকিম এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন যা ‘আল-হাকিম মসজিদ' নামে পরিচিত। আল-হাকীমের এ মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেছে। সোনালী প্রাসাদ, মুক্তাভবন, কারাফা সমাধিক্ষেত্রে মায়ের নামে মসজিদ তাঁর উল্লেখযোগ্য নির্মাণ
আল-আযিযের চরিত্র-কৃতিত্ব : Lane-Poole (History of Egypt in the Middle Ages) গ্রন্থে তাঁর চরিত্রের কতগুলো দিক উল্লেখ করেছেন: দীর্ঘকায়, লাল চুল, নীল চোখ, সাহসী, দক্ষ শিকারী, নির্ভীক সেনাপতি, উদার, সমঝোতার মানসিকতাকামী ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শান্তিকামী। তিনি সোনার তৈরি পাগড়ি, স্বর্ণখচিত তলোয়ার, মূল্যবান চমৎকার পরিচ্ছদে অলংকৃত হতেন। তাঁর উমারারও শান-শওকতপূর্ণ বেশভূষা ছিল। মূল্যবান একখানা পারস্যের রেশমী পর্দার জন্য খরচ করা হত ১২ হাজার পাউন্ড সমমানের স্বর্ণমুদ্রা। তাঁর দরবারে চাকরানি ব্যতীত ৮০০ মহিলা ছিল। তিনি জুমুআর দিনে রাষ্ট্রীয় শোভাযাত্রার প্রচলন করেন। তিনি জনগণের মাঝে সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জামাআত পরিচালনা করতেন।
উত্তরাধিকারী মনোনয়ন : আল-আযিয ২১ বছর শাসন করে ৪১ বছর বয়সে অর্থাৎ ৯৯৬ সালে মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর পুত্র আল-হাকিমকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কোষাধ্যক্ষ বারজোয়ানকে তিনি তাঁর ১১ বছর বয়সী পুত্র আল-হাকিমের অভিভাবক এবং কাজী মুহম্মদ নুমান ও সেনাপতি হাসান বিন আম্মারকে উপদেষ্টা মনোনীত করে যান ।
সারসংক্ষেপ
৯৭৫ সালে আল-মুইযের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আল-আযিয ২০ বছর বয়সে ক্ষমতাসীন হন। তিনি হাস্তাকিন ও
কারামতিয় নেতা হাসান বিন আহমেদকে পরাজিত করে সিরিয়া জয় করেন। পরে হাস্তাকিনের সাথে আনীত বন্দী | তুর্কিদের নিয়ে একটি তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়। তিনি খ্রিস্টান-ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ উদারতা প্রদর্শন করেন । তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে ঈসমাইলীয় মতবাদ প্রচার করেন। আল-আযিয একজন বিজ্ঞ শাসক ছিলেন । তিনি আল-আযহার মসজিদকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর রাজপ্রাসাদে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয় যেখানে ২ লক্ষ গ্রন্থ ছিল। সোনালী প্রাসাদ ও মুক্তাভবন তার উল্লেখযোগ্য নির্মাণ-কর্ম। তাঁর উযির ইয়াকুব বিন কিল্লিসও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
 


পাঠ-১০.৫
আল- হাকিম
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
বারজোয়ার ও ইবনে আম্মারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্ধ ও আল-হাকীমের ক্ষমতা হস্তগতকরণের বর্ণনা দিতে পারবেন।
আল-হাকিমের বিভিন্ন নীতি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জনকল্যাণে তাঁর অবদান আলোচনা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
বারজোয়ান, ইবনে আম্মার, মনজুতাকিম, হুসাইন ইবনে জাওহার, আবু রাকওয়া,
আরসেনিয়াস, কির্তি, দারাজী, দারুল হিকমাহ্ ও আল-মুকাত্তাম
৯৯৬ সালে আল-আযিযের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আল-মনসুর আবু আলী ‘আল-হাকিম বি আল্লাহ্” উপাধি নিয়ে সিংহাসন লাভ করেন। ফাতিমি ইতিহাসে তিনি একজন বিতর্কিত শাসক ছিলেন। তাঁর নীতিসমূহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তাঁকে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।
বারজোয়ান ও ইবনে আম্মারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব : ক্ষমতা গ্রহণের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। অপ্রাপ্ত বয়সের কারণে গৃহশিক্ষক বারজোয়ানকে তাঁর তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়। কাজী মুহম্মদ নুমান ও সেনাপতি হাসান বিন আম্মারকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। কিন্তু পরে তাঁর অভিভাকত্ব নিয়ে বারজোয়ান ও ইবনে আম্মারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ক্ষমতালোভী ইবনে আম্মার প্রথমে ঈসা বিন নেসতুরিয়াসকে অপসারণ করে উযির পদটি দখল করে নেন। বারজোয়ান সিরিয়ার গভর্নর মনজুতাকিম ও তুর্কী সেনাদের সাহায্যে ইবনে আম্মার ও তার সমর্থক বার্বারদের দমনের চেষ্টা করেন। বার্বার ও তুর্কীদের মধ্যে সংঘর্ষে ইবনে আম্মার শেষ পর্যন্ত আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। পরে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। এরপর তাঁকে মুক্ত করে দেয়া হয়। পরে তাঁকে বিচারের জন্য আদালতে হাযির করা হলে তুর্কীরা তাঁকে আক্রমণ করে হত্যা করে। ফলে ইবনে আম্মারের ১১ মাসের প্রবল উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা নিঃশেষ হয় এবং বারজোয়ান খলিফার প্রকৃত অভিভাবক, প্রধান উযির ও সচিব পদে ফিরে এসে ফাতিমি শক্তি পুন:প্রতিষ্ঠিত করেন।
বারজোয়ানকে হত্যা ও হুসাইন ইবনে জাওহারকে উযির নিয়োগ : বারজোয়ান ইবনে আম্মারের হত্যার পর খলিফার অভিভাকত্বের অযুহাতে প্রকৃত শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বারজোয়ানের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অত্যন্ত গোপনে খলিফা তাঁকে হত্যা করেন। এরপর হুসাইন ইবনে জাওহারকে উযির হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
আবু রাকওয়াকে পরাজিত ও হত্যা : স্পেনের একজন উমাইয়া রাজপুত্র আবু রাকওয়া উত্তর আফ্রিকায় পালিয়ে আসেন এবং সেখানকার আরব ও বার্বারদের সাহায্যে বার্কা দখল করে কায়রোর দিকে অগ্রসর হন। গিজার যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও হত্যা করা হয়। তার ৩০ হাজার অনুসারীকে বন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। উযির হুসাইন ও কাজী আব্দুল আযিয বিন মুহম্মদ বিন নুমানকে আবু রাকওয়ার সাথে গোপন ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে হত্যা করা হয়।
আল-হাকিমের নীতিসমূহ : খলিফা আল-হাকিম কতগুলো নতুন নিয়ম চালু করেন। যেমন, খলিফাকে ‘আমাদের মালিক’ বা ‘আমাদের প্রভূ’ বলে সম্বোধন নিষিদ্ধ হয় এবং এর পরিবর্তে শুধু আমীরুল মুমেনিন সম্বোধন করার আদেশ জারী করা হয়। এ আদেশ লঙ্গনকারীদের মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত করার আদেশ জারী করা হয়। দিনের পরিবর্তে রাতের গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মন্ত্রী বা উপদেষ্টা পরিষদের সভা রাতে আহবান করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য রাতে পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। সরকারী অফিসসমূহ রাতে খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সমগ্র রাতব্যাপী দোকান খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। মহিলাদের ঘরের বাইরে গমন নিষিদ্ধ হয়। মুচিদের মহিলাদের বাইরে গমনের জুতা তৈরী না করতে আদেশ দেয়া হয়। মদ নিষিদ্ধ হয়, মদের পাত্রগুলো ভেঙ্গে দেয়া হয়। দাবা, জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়। শুকর, কুকুর হত্যা করা হয় এবং গবাদি পশু
 


জবাই নিষিদ্ধ করা হয়। খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কালো পোশাক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। খ্রিস্টানদের ক্রুশ ও ইহুদিদের কাঠের বাছুরের প্রতিকৃতি অথবা ঘন্টা পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। আযানে ‘হাইয়া আলাল ফালাহ্' রহিত করা হয়। লুপিন, ওয়াটার ক্রেস, মুলুখিয়া ও অন্যান্য আগাছা জাতীয় গাছ উৎপাদন নিষিদ্ধ হয়। আইশ ছাড়া মাছ শিকার ও আহার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে সম-সাময়িক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে কিছু নীতির যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
খ্রিস্টানদের প্রতি নীতি : রাজত্বের প্রথম দিকে খ্রিস্টানদের প্রতি নীতির ক্ষেত্রেই তিনি পিতার নীতি অনুসরণ করেন। ১০০০ সালে মামা আরসেনিয়াসকে আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান বিশপের পদে অধিষ্টিত করেন। অন্য একজন খ্রিস্টান মামা ওরেসটিসকে জেরুজালেমের বিশপ নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীকালে খ্রিস্টানদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। ১০০৯ সালে তিনি জেরুজালেমের প্রধান গির্জা ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। এটা পরে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১০১০ সালে আরসেনিয়াসকে হত্যা করা হয়। মালেকী খ্রিস্টানদের উপর অত্যাচার করা হয় এবং তাদের গির্জার দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক কিতি (Coptic) খ্রিস্টানদের খুশি করা ও তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করা। তাদের উপর থেকে কর প্রত্যাহার করা হয়। এতে কিত্তিরা সন্তুষ্ট হয়েছিল। তবে মালেকী খ্রিস্টানদের প্রতি তাঁর এই বৈরী আচরণের কারণে বাইজানটাইনদের সাথে ফাতিমিদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
দারাজী মতবাদ : তাঁর সময়ে পারস্য থেকে দারাজীরা মিসরে এসে আল-হাকীমকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত বলে প্রচার করতে থাকে। তাদের নেতা হামযা বিন আলীর প্রভাবে খলিফা নিজেকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন ভাবতে থাকেন। তিনি সালাত, সাওম ও হজ্জ পালন নিষেধ করেন। ১০১৭ সালে তারা খলিফাকে ‘আল্লাহর অবতার' বলে ঘোষণা করলে তিনি তাতে সম্মতি দেন। রাস্তায় বের হলে দারাজীরা তাঁকে সেজদা করে। ১০২১ সালে দারাজীদের প্রচার কেন্দ্র মুকাত্তাম পৰ্বতে আল-হাকিম রাতের বেলায় গমন করলে সেখানেই তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। দারাজীরা বিশ্বাস করে যে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন এবং আবার ফিরে আসবেন।
আল-হাকিমের নীতির পরিবর্তন : ১০১১ সালের পর মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি-সকল শ্রেণীর প্রতি জারীকৃত অনেক কড়াকড়ি আদেশ শিথিল করা হয়। তাঁর সময় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিয়াগণ কায়রোতে এসে বসবাস করতে শুরু করে। ১০১১ সালে তিনি কায়রোর সুন্নী মুসলিমদেরকে খুশী করার জন্য হযরত আবু বকর ও উমরের (রা.) লাশদ্বয় মদীনা থেকে এনে কায়রোতে সমাধিস্থ করার এক জঘন্য পরিকল্পনা করেন। এজন্য একজন গুপ্তচর ও খলিফাদ্বয়ের কবরের কাছে বসবাসকারী এক শিয়াকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই বাড়ি হতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে লাশ অপহরণের চেষ্টা চালানো হয়। খননকার্য চলা অবস্থায় হঠাৎ এক ভয়ংকর ঝড় শুরু হলে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মদিনার গভর্নরের কাছে কৃতকর্মের কথা স্বীকার করে। গভর্নর তাদের শাস্তি প্রদান করেন। আল-হাকিম আবার আদেশ জারি করেন যে আযানে ‘আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম'-বলা যাবেনা; সালাতুজ্‌-যোহা ও রমযানে তারাবীর সালাত আদায় করা যাবেনা। ফুতাত জামে মসজিদের ইমাম এই আদেশ না মানলে তাঁকে হত্যা করা হয়।
দারুল হিকমাহ্ প্রতিষ্ঠা : ১০০৫ সালে আল-হাকিম ‘দারুল হিকমাহ্’ বা ‘দারুল ইলম্‌ (Hall of Wisdom/Hall of Knowledge) প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত শিয়া মতবাদ প্রচার ও শিক্ষার জন্য এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞানের প্রসারে বিশেষ অবদান রাখে। এই প্রতিষ্ঠানটি রাজপ্রাসাদের সাথে যুক্ত ছিল। এখানে একটি বিশাল পাঠাগার ছিল জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, ব্যাকরণ, আইন, ভাষা ইত্যাদি বিষয়ে এখানে চর্চা করা হত। পণ্ডিত ও গবেষকদের সমাবেশ ঘটে এখানে। প্রখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ইবনে হায়সামকে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত করার দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। ১১১৯ সালে প্রচলিত ধর্মবিরোধিতার অভিযোগে উযির মালিক আল-আফজাল এটিকে বন্ধ করে দেন। পরে আবার চালু হয় এবং আইয়্যূবীদের উত্থান পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ছিল।
মানমন্দির নির্মাণ : আল-হাকিম জোতিষশাস্ত্রে আগ্রহী ছিলেন। তিনি জোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য আল-মুকাত্তাম নামক পর্বতে একটি মানমন্দির স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সময়ে আলী বিন ইউসুফ মিসরের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ ছিলেন।
জনহিতকর কার্যাবলি : তিনি রাজপথ সংস্কার করেন। রাস্তার পাশে কুপ খনন ও ঝর্ণার ব্যবস্থা করেন। একদিনের

 


যাত্রাপথের দূরত্বে পথিকদের জন্য সরাইখানা নির্মাণ করেন। গরীব ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাস, রুগ্নদের জন্য হাসপাতাল, যুবকদের জন্য বিদ্যালয় নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর পিতার আমলে শুরু হওয়া আযিযিয়া মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন এবং নাম দেন আল-হাকিম মসজিদ। এছাড়া রাশিদিয়া মসজিদ নির্মিত হয়। মাস-এ তিনি আর একটি মসজিদ নির্মাণ করেন । প্রাদেশিক শহরগুলোতে হাম্মামখানা, ঝর্ণা, বাজার, কুপ ইত্যাদি নির্মাণ করেন। তিনি প্রকৃতি-প্রেমী ছিলেন। জনসাধারণকে তাদের গৃহাঙ্গণে ও গৃহের আশেপাশে বাগান তৈরিতে অনুরোধ করেন। তাঁকেও প্রায়ই রাজকীয় বাগানের পরিচর্যা করতে দেখা গেছে।
সারসংক্ষেপ:
খলিফা আল-হাকিম ফাতিমি ইতিহাসে একজন বিতর্কিত শাসক ছিলেন। তাঁর নীতিসমূহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তাঁকে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। তিনি কতগুলো নতুন ও উদ্ভট নিয়ম চালু করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিও তিনি ভারসাম্যহীন নীতি আরোপ করেন। তিনি দারাজী মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি শিয়া মতবাদ প্রচার ও শিক্ষার জন্য দারুল হিকমাহ্ এবং জোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য মানমন্দির স্থাপন করেছিলেন ।
 

 

 


পাঠ-১০.৬
ফফাতিমিদের পতন
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
ফাতিমি খিলাফতের পতনের কারণসমূহ ব্যাখ্যা করতে পারবেন ও
সালাহ্উদ্দিন আইয়ূবীর মিসরে আগমন ও ফাতিমিদের পতন সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
| বদর আল-জামালী, হজ্বরে আওয়াদ্ লুণ্ঠন, নিজারীয়, তাইয়েবীয়, ক্রুসেড, সাওয়ার, শিরকুহ, জঙ্গি ও সালাহউদ্দিন আইয়্যবী
৯০৯ সালে ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠার পর পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী ধরে গৌরবের সাথে এর যাত্রা অব্যাহত থাকে। কিন্তু যে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ফাতিমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত বজায় থাকেনি। একটি শিয়া মতাবলম্বী খিলাফত হিসেবে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে টিকে থাকার জন্য যে শক্তি ও সামর্থ্যের প্রয়োজন ছিল তা শেষ দিকের শাসকদের, বিশেষ করে আল-হাকিমের পরবর্তী দুর্বল খলিফাদের ছিলনা। ফলে ফাতিমি খিলাফতের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।
ফাতিমি খিলাফতের পতনের কারণ
১১৭১ সালে সর্বশেষ খলিফা আল-আদিদের মৃত্যুর পর সালাহ্উদ্দিন আইয়্যূবীর ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ফাতিমি বংশের পতন হয়। কিন্তু তাদের পতনের প্রেক্ষাপট আগে থেকেই তৈরী হয়েছিল। ফাতিমিদের পতনের কারণগুলো নিম্নরূপ :
খলিফাদের দুর্বলতা : ফাতিমিদের শেষদিকের খলিফাগণ বিশেষ করে আল-হাকিমের পরবর্তী খলিফাগণ ছিলেন অযোগ্য, অদক্ষ, অকর্মণ্য এবং তাঁদের অধিকাংশই ছিল নাবালক। আল-হাকিমের মৃত্যুর পর প্রকৃত ক্ষমতা উযিরদের হাতে চলে যায় এবং নাবালক উত্তরাধিকারীগণ তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। এসব উযিরদের মধ্যে বদর আল-জামালী (১০৭৩-৯৪), আল-আফজাল (১০৯৪-১১২১), আবু আলী আহমদ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তাঁরা খলিফাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নেন।
সুন্নীদের বিরোধিতা
ফাতিমি খিলাফতের চারদিকে সুন্নী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে সুন্নী আব্বাসীয়দের শাসন চলে। ইউরোপের স্পেনে সুন্নী উমাইয়ারা স্বাধীনভাবে শাসন করছিল। ফলে গোটা মুসলিম জাহানে সুন্নীদের প্রবল বিরোধিতার মোকাবিলা করেই শিয়া ফাতিমিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এ সময় শিয়া মতবাদপুষ্ট উগ্রপন্থী কারামাতিয় সম্প্রদায় কাবা আক্রমণ করে হজ্বরে আওয়াদ্ লুন্ঠন করায় সুন্নী ও মধ্যপন্থী শিয়ারা তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। এই ঘটনা বিশেষ করে সুন্নীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে এবং শিয়াদের প্রতি প্রতিশোধের বাসনা বংশ পরম্পরায় চলে আসতে থাকে।
শিয়া মতবাদ প্রচার বিঘ্নিত
ফাতিমিদের প্রথমদিকের খলিফাগণ রাজ্য শাসনের সাথে সাথে শিয়া মতবাদ প্রচারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্রচারে ভাটা পড়ে। ফলে জনগণের মন-মানসিকতা শিয়ামত থেকে অন্যদিকে ধাবিত হয় এবং এর বহুধা বিভক্তি ঘটে । ফাতিমি রাজ্যে ঈসমাইলীয়, নিজারীয়, তাইয়েবীয়, দারাজী, কারামাতিয় প্রভৃতি দল-উপদলগুলি মিসর, সিরিয়া, ইয়ামেন, উত্তর আফ্রিকা প্রভৃতি অঞ্চলে স্বতন্ত্র পরিচয়-পতাকা নিয়ে প্রচার-কার্যের ফলে শিয়া মতবাদের খুবই ক্ষতি হয়।
খাদ্যাভাবের প্রভাব : বারংবার দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব ও রাজস্ব ঘাটতি মিসরকে দারুণভাবে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া
রাজকোষ অর্থশূণ্য হয়ে যাবার কারণে সময় সময় বাইরের শত্রু শক্তির কাছে নিতান্ত হীন স্বার্থে সাহায্য চাইতে হত। এর
 

 


প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট হত। রাজস্বের ঘাটতি মোকাবিলা করতে গিয়ে রাজদরবারের সঞ্চিত সম্পদ, রত্ন ও অলংকারেও টান পড়ে।
সামরিক ক্ষমতা হ্রাস : মধ্যযুগে যে সময় শক্তির উৎস হিসেবে সামরিক বাহিনীর রণকুশলতা, দক্ষতা ও সাহসিকতা অপরিহার্য সে সময় অর্থাৎ ফাতিমি শাসনের শেষ দিকে সামরিক বাহিনী আত্মঘাতী গোষ্ঠীকলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। জনগণের নিরাপত্তার রক্ষাকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের যখন শ্রদ্ধা ও ভক্তি থাকার কথা, তখন তারা জনগণের জানমাল ও ইজ্জতের হরণকারীরূপেই পরিচিত হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর প্রতি অবহেলা এবং খলিফাদের পক্ষে বিশাল সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের অক্ষমতা তাদের সামরিক শক্তিকে হ্রাস করে যা তাদের পতন ত্বরান্বিত করে।
ক্রুসেডের প্রভাব : ১০৯৭ সালে ক্রুসেডার বা খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য এশিয়াতে উপস্থিত হলে ফাতিমিরা তুর্কী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য ধর্মযোদ্ধাদের স্বাগত জানায়। ফল ক্রুসেডারদের পক্ষে প্রাচ্যে অনুপ্রবেশ আরও সহজতর হয়। তারা জেরুজালেম, এডেসা, এন্টিওক ও সিরিয়ার বেশ কিছু অংশ দখল করে নিজেদের শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এমনকি যখন সেলজুক তুর্কীরা মিসরের উপকণ্ঠে তখনও তারা তাদের প্রতিহত করার জন্য বিরাট অংকের ধনরত্ন ক্রুসেডারদের প্রদানে সম্মত হয়। তাদের এই অদূরদর্শী ও আত্মবিনাশী ভাবনা তাদের পতনের কারণ হয়েছিল।
সুন্নী নিপীড়ন : ফাতিমি খলিফাগণ বিশেষ করে খলিফা আল-হাকিম ছিলেন সুন্নী-বিদ্বেষী। আল-হাকিম সুন্নী সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে থাকেন। এছাড়া তিনি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের উপহার প্রদান বন্ধ করে দেন। মালিকী মাদ্রাসাও বন্ধ করে দেন। ফলে সুন্নীগণ ফাতিমি খিলাফতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
অমুসলিম নির্যাতন : অমুসলিমদের উপর নির্যাতন ফাতিমি বংশের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। ফাতিমি খলিফা আল- হাকিম সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি অমুসলিমদের প্রতি নির্যাতনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অমুসলিমদেরকে তাঁর তৈরিকৃত বিভিন্ন আইন মেনে চলতে বাধ্য করেন। তাঁর রাজত্বে ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান এবং গলায় ক্রুশ ও ঘন্টা পরতে হত। ফলে ইহুদি ও খ্রিস্টানগণ ফাতিমি খিলাফতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
অর্থনৈতিক অবক্ষয় : ফাতিমি খিলাফতের শেষ দিকে অযোগ্য খলিফারা উযিরদের হাতে রাজ্যের সকল ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে হারেমে বিলাসী জীবন-যাপন করে প্রচুর অর্থ অপচয় করতেন। অন্যদিকে উযিররাও শাসনকার্যে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে বিপুল অর্থের অপচয় করত। এছাড়া ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং জেরুজালেমে ক্রুসেডারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বহি:বাণিজ্যে প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে রাজকোষ শূণ্য হয়ে পড়ে এবং অর্থের অভাবে ফাতিমি অবকাঠামোগুলো ভেঙ্গে পড়ে। অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
সালাহ্উদ্দিন আইয়্যবীর আগমন ও ফাতিমিদের পতন : ফাতিমি উযির সাওয়ার তুর্কীদের সাহায্যে উযির পদ লাভ করলেও পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কদের সাহায্যে তুর্কিদের সিরিয়ায় তাড়িয়ে দেন। তুর্কীরা যখন মিসরের উপকণ্ঠে তখন তাদের প্রতিহত করার জন্য বিরাট অংকের অর্থের বিনিময়ে তিনি ফ্রাঙ্কদের মিসরে আহ্বান জানান। কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। স্বয়ং খলিফা ও নগরের অভিজাত রমণীদের আমন্ত্রণে সিরিয়ার নুরুদ্দীন জঙ্গি তাঁর সেনাপতি শিরকুহ এবং সালাহউদ্দিনকে ফ্রাঙ্কদের বিতাড়নের জন্য প্রেরণ করেন। মিসরে তুর্কী সেনারা বিজয়ীবেশে প্রবেশ করল। সালাহ্উদ্দীন এবং শিরকুহের গতি রোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শিরকুকে উযিরের পদে নিয়োগ করা হয়। ২ মাস পরে শিরকুহ মৃত্যুমুখে পতিত হলে সালাহ্উদ্দিন উযির পদ গ্রহণ করেন। ১১৭১ সালে সর্বশেষ খলিফা আল-আদিদের মৃত্যু হলে সালাহ্উদ্দিন আব্বাসীয়দের অনুকূলে আইয়্যূবী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। খুত্বায় আব্বাসীয় খলিফার নাম পাঠ করা হয়। আর এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে ২৬২ বছরের ফাতিমি শাসনের।
উপর্যুক্ত নানা কারণে ফাতিমিদের অধঃপতনের ধারা সূচিত হয় এবং এই বংশের শক্তি এতটাই কমে যায় যে তাদের কখনও সেলজুক তুর্কীদের, কখনও ফ্রাঙ্ক ক্রুসেডারদের আবার কখনওবা সিরিয়ার জঙ্গি তুর্কিদের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি সালাহ্উদ্দিন আইয়্যবীর আইয়্যবী বংশ প্রতিষ্ঠার পর ফাতিমি বংশের পক্ষে কেউ কোন দাবী উপস্থাপন করেনি বা করার সাহস দেখায়নি। ফলে ফাতিমিদের ধ্বংসস্তুপের উপর আইয়্যবী বংশ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলামী বিশ্বের একমাত্র শিয়া তথা ফাতিমি খিলাফতের চির অবসান ঘটে।
 

 


পাঠ-১০.৭
জ্ঞান-বিজ্ঞানে ফাতিমিদের অবদান
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
ফাতিমিদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা ও জ্ঞানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলতে পারবেন;
জোতির্বিজ্ঞান, চক্ষু ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁদের অবদান আলোচনা করতে পারবেন ও
তাঁদের শিল্পকলা, স্থাপত্য, নক্শা ও খোদাই শিল্প সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন ।
মুখ্য শব্দ
দারুল হিকমাহ্, আল-আযিযের লাইব্রেরি, আলী বিন ইউসুফ, ইবনে হায়সাম, আল- বাব
আল-জাওয়িলা, বাব আল-নাসর ও বাব আল-ফুতুহ্
৯০৯ সালে উত্তর আফ্রিকায় ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথমত তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে। পরবর্তীতে তাদের অস্তিত্বের জন্য অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাও তাদের নিকট মুখ্য হয়ে ওঠে। পাশাপাশি প্রথম দিকের খলিফারা তাদের সাংস্কৃতিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ৯৬৯ সালে মিসর জয় এবং ৯৭৩ সালে কায়রোতে রাজধানী স্থাপনের ফলে একই সময় বাগদাদ, কর্ডোভা ও কায়রো-এই ত্রিমাত্রিক ইসলামী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কায়রো অন্যান্য দিক থেকে বাগদাদ এবং কর্ডোভার সমকক্ষ কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাগদাদ এবং কর্ডোভা থেকে পিছিয়ে ছিল। এর প্রধান কারণ হল ফাতিমিরা তাদের রাজদরবারে জ্ঞানী-গুণীদের আকর্ষিত করতে পারেনি। কারণ ফাতিমি রাজদরবারে তাদের জীবনের নিরাপত্তা কম ছিল। বিশেষ করে ফাতিমিদের শেষ যুগে এই ব্যাপারটি আরও বেশি প্রযোজ্য ছিল। ফাতিমি শাসনামলে পারসিক সংস্কৃতির প্রভাবই ছিল বেশি ।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা : ফাতিমিদের মধ্যে যিনি জ্ঞানের প্রথম এবং উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাঁর নাম ইবনে কিলিস। তিনি একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে প্রতি মাসে ১ হাজার দিনার খরচ করা হত। প্রথম দিকের ফাতিমি খলিফারা সংস্কৃতি-মনস্ক ছিলেন। খলিফা আল-আযিয নিজে একজন কবি এবং বিদ্যুৎসাহী ছিলেন। তিনি আল-আযহার মসজিদকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
দারুল হিকমাহ্ : খলিফা আল-হাকিম ১০০৫ সালে শিয়া মতবাদ প্রচার ও শিক্ষার জন্য দারুল হিকমাহ্ বা দারুল ইলম্‌ (Hall of Wisdom/Hall of Science) প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের জন্য তিনি একটি তহবিল তৈরি করেন। এই তহবিল থেকে কিছু অর্থ পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি তৈরি, সংস্করণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় করা হত। এই প্রতিষ্ঠানটি রাজপ্রাসাদের সাথে যুক্ত ছিল। এখানে পাঠাগার ছিল এবং সভার জন্য কক্ষ বরাদ্ধ ছিল। ইসলামী বিষয়সহ জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র ইত্যাদি চর্চা করা হত এখানে। ১১১৯ সালে প্রচলিত ধর্ম বিরোধিতার অভিযোগে উযির মালিক আল-আফজাল এটিকে বন্ধ করে দেন। পরে আবার চালু হয় এবং আইয়্যূবীদের উত্থান পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ছিল।
রাজকীয় লাইব্রেরি : খলিফা আল-আযিযের সময় রাজপ্রাসাদে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। সে সময় এই গ্রন্থাগারে ২ লক্ষ গ্রন্থ ছিল। সেখানে ছিল ব্যাখ্যাসহ কুরআনের বিভিন্ন গ্রন্থ। ইবনে মুকলা এবং অন্যান্য বিখ্যাত লিপিকাররা পাণ্ডুলিপি লিখতেন। আল-আযিয তাঁর এই গ্রন্থাগারের জন্য তাবারীর স্বাক্ষরিত তাঁর ইতিহাস বইয়ের একটি কপি সংগ্রহ করেন। ১০৬৮ সালে আল-মুস্তাসিরের সময় তুর্কীরা কায়রোতে লুটতরাজ চালায় এবং তারা এই লাইব্রেরি থেকে মূল্যবান পাণ্ডুলিপি ২৫ টি উটের পীঠে চাপিয়ে নিয়ে যায়। এই মূল্যবান পাণ্ডুলিপিগুলো তুর্কী অফিসাররা তাদের বাড়িতে আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করেছিল। এসব বইয়ের মলাট তুর্কী অফিসাররা তাদের ক্রীতদাসদের জুতা মেরামতের কাজে ব্যবহার করত। আল-মুস্তানসিরের বংশধররা এই লাইব্রেরির জন্য নতুন বই সংগ্রহ করেছিল। সালাহ্উদ্দিন আইয়্যবী যখন মিসরে আইয়ূবী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন তখনও সেখানে লক্ষাধিক বই ছিল। সালাহ্উদ্দিন আইয়্যূবী অন্যান্য সম্পদের
 

 

 


মত এই পাঠাগারের কিছু বই তাঁর লোকদের মধ্যে বিতরণ করেন।
জোতির্বিজ্ঞান : আল-হাকিম জ্যোতিষশাস্ত্রে আগ্রহী ছিলেন। তিনি জোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য আল-মুকাত্তাম নামক পর্বতে একটি মানমন্দির স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সময়ে আলী বিন ইউসুফ মিসরের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জোতির্বিদ ছিলেন। চক্ষু ও চিকিৎসা বিজ্ঞান: ফাতিমিদের একজন বিখ্যাত চক্ষু বিজ্ঞানী ছিলেন ইবনে আল-হায়সাম। চক্ষু বিজ্ঞান ছাড়াও তিনি গণিত, জোতির্বিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর চক্ষু চিকিৎসা সংক্রান্ত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম “কিতাবুল মানাযির'। মধ্যযুগের চিকিৎসা সংক্রান্ত অধিকাংশ রচনাই ইবনে আল-হায়সামের Optica Thesaurus-কে ভিত্তি করে রচিত হয়। রজার বেকন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ও কেপলারের উপর ইবনে আল-হায়সামের প্রভাব সুস্পষ্ট। আল-হাকীমের আমলে আম্মার ইবনে আলী আল-মাওসিল নামক চক্ষুবিদ ‘আল-মুন্তাখাব ফি ইয়াজ আল- আইন' (Select Materials on the Treatment of Eye / চক্ষু চিকিৎসার উপর নির্বাচিত সামগ্রী) নামক একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি নলের সাহায্যে চোখের ছানির অস্ত্রোপচারের বর্ণনা দিয়েছেন এবং এই নল তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। মুহম্মদ আল-তামিমি চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি জেরুজালেমে জন্মগ্রহন করেন এবং ৯৭০ সাল নাগাদ মিসরে আগমন করেন।
শিল্পকলা ও স্থাপত্য : ফাতিমিরা শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ অবদান রেখেছিল। ফাতিমি যুগের স্থাপত্যের যেসব নিদর্শন আজও রয়েছে এর মধ্যে প্রাচীনতম হল আল-আযহার মসজিদ। ৯৭২ সালে জওহর এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ৯৯০ সালে আল-আযিয আর একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন এবং ১০১২ সালে আল-হাকিম এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। আল-হাকিমের এ মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ১১২৫ সালে একজন আর্মেনীয় খ্রিস্টান স্থপতি কর্তৃক আল- আকমার মসজিদ নির্মিত হয়। ১১৬০ সালে নির্মিত আল-সালিহ ইবনে রুজ্জিক মসজিদ গাত্রের শিল্প ও লিপিকলা ফাতিমিদের শিল্পকলার খ্যাতি বৃদ্ধি করেছিল। ১০৮৫ সালে মসজিদের সাথে মসজিদ-প্রতিষ্ঠাতার কবর তৈরির প্রথা চালু হয়। আল-মুকাত্তাম পর্বতে বদর আল-জামালী প্রতিষ্ঠিত সমাধি-মসজিদটি এ ধারার প্রথম মসজিদ। এ যুগের শিল্পশোভার স্বাক্ষর বহনকারী তিনটি তোরণ আজও বর্তমান। এগুলো হল বাব আল-জাওয়িলা, বাব আল-নাসর ও বাব আল-ফুতুহ । এডেসার স্থপতিরা এগুলো নির্মাণ করেছিলেন। কায়রোর এই তোরণগুলোর ধ্বংসবশেষ ফাতিমি মিসরের গৌরবের উল্লেখযোগ্য সাক্ষী ।
নকশা ও খোদাই শিল্প : ফাতিমি যুগের কাঠের উপর খোদাইয়ের নানাবিধ কাজ রয়েছে। এতে নানা ধরনের পশুপাখির নমুনা খোদাই করা হয়। ব্রোঞ্জের তৈরি আয়না ও হাতলওয়ালা জগের উপরও এ ধরনের কাজ দেখা যায়। বস্ত্র শিল্পে ইরানের প্রভাব ছিল। এ যুগে মিসরের বস্ত্রে জন্তুদের নক্শা করা থাকত। সিরামিকের ক্ষেত্রেও মিসরীয় শিল্পিরা ইরানী শিল্পশৈলীকে অনুসরণ করে। ঐতিহাসিক মািিয ফাতিমিদের শিল্প-সম্পদের তালিকায় মৃৎ শিল্প ও ধাতব সামগ্রীর কথা
উল্লেখ করেছেন। মিসরের তৈরী মাটির জিনিস এতই সুক্ষ্ম এবং স্বচ্ছ ছিল যে এর ভিতর দিয়ে হাত দেখা যেত । এছাড়া ফাতিমি যুগের একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ছিলেন ইবনে সালমা আল-কুদাই, যিনি ১০৬২ সালে ফুস্তাতে মারা যান। ফাতিমিগণ একদিকে কর্ডোভার উমাইয়া এবং অন্যদিকে বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের মধ্যস্থিত হওয়ায় ক্রমাগত আক্রান্ত হবার ভীতি জ্ঞান-সাধকদের কায়রোমূখী হওয়া থেকে অনেকটা বিরত রেখেছিল। তদুপরি জোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও স্থাপত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর দেখতে পাওয়া যায় ।
সারসংক্ষেপ :
ফাতিমিগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথম দিকের খলিফাগণ তাদের সাংস্কৃতিক | মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। জ্ঞান চর্চার জন্য একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। খলিফা আল-আযিয আল-আযহার মসজিদকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খলিফা আল-হাকিম প্রতিষ্ঠিত দারুল হিকমাহ্ ছিল জ্ঞান চর্চার একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। খলিফা আল-আযিযের সময় রাজপ্রাসাদে একটি পাঠাগার জোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য একটি মানমন্দির স্থাপন করা হয়। তার আমলে চিকিৎসা বিদ্যা, স্থাপত্য শিল্প ও সাহিত্যে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।
 


পাঠ-১০.৮
ক্রুসেড
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
ক্রুসেডের বিভিন্ন কারণ আলোচনা করতে পারবেন;
ক্রুসেডের পর্বসমূহ উল্লেখ করতে পারবেন ও ক্রুসেডের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে পারবেন ।
জেরুজালেম, সামন্ততন্ত্র, সেলজুক, সম্রাট আলেকসিয়াস কমনেনাস, পোপ আরবান, ক্লেরমোন্ট, ক্যাথলিক ধর্ম, রেনেসা ও আধুনিক ইউরোপ
‘ক্রুসেড’ শব্দের অর্থ ধর্মযুদ্ধ। অর্থাৎ খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধকে ‘ক্রুসেড' বলা হয়। একাদশ শতকের শেষভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় দু'শ বছরব্যাপী (১০৯৬-১২৯১) ইউরোপের খ্রিস্টানরা যিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের নামে প্রাচ্যের মুসলিমদের সাথে যে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল ইতিহাসে তা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ক্রুশ চিহ্ন ধারণ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল ।
ক্রুসেডের কারণ :
ক্রুসেডের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সংক্ষেপে কারণগুলো নিম্নরূপ: ধর্মীয় কারণ : যিশুখ্রিস্ট বা হযরত ইসার (আ.) জন্মস্থান, মহানবী হযরত মুহম্মদের (সা.) মিরাজ গমণের স্থান এবং হযরত মুসা, দাউদ ও সুলাইমানের (আ.) স্মৃতি বিজড়িত স্থান হিসেবে জেরুজালেম খ্রিস্টান, মুসলিম ও ইহুদিদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র স্থান। সপ্তম শতক থেকে এটি মুসলিমদের অধীনে থাকে। একাদশ শতকের শেষ দিকে ধর্মোন্মত্ত খ্রিস্টানরা নানা অযুহাতে মুসলিমদের নিকট থেকে জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য ধর্মযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
খলিফা আল-হাকিম ও সেলজুকদের নীতি : ১০০৯ সালে ফাতিমি খলিফা আল-হাকিম তাঁর রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক কিতি (Coptic) খ্রিস্টানদের খুশি করা ও তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করার জন্য বাইজানটাইনদের সমর্থনপুষ্ট মালেকী খ্রিস্টানদের নিয়ন্ত্রিত জেরুজালেমের প্রধান গির্জা ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। এছাড়া সেলজুক তুর্কীদের অধীনে থাকাকালে খ্রিস্টানদের জেরুজালেমে গমনে বাধা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। আক্রান্ত খ্রিস্টানরা দেশে ফিরে তাদের প্রতি অত্যাচারের কথা স্ব-জাতির কাছে প্রচার করে। এসব কারণে খ্রিস্টানরা জেরুজালেমকে মুক্ত করতে উদ্যত হয়।
ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের প্রভাব : ইউরোপে এ সময় সামন্ততন্ত্র বা ভূমি-কেন্দ্রিক এক ধরনের ব্যবস্থাপনা বা এক কথায় জমিদারতন্ত্র প্রচলিত ছিল যেখানে সামন্তরাজাদের পুত্রগণ আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করত। খ্রিস্টান ধর্মগুরুগণ তাদের সামরিক দক্ষতা ও শক্তিকে নিজেদের মধ্যে অপব্যয় না করে কৌশলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করেন।
বাণিজ্যিক কারণ : মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগরসহ গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বাণিজ্যিক পথগুলো মুসলিমদের দখলে ছিল। এতে
খ্রিস্টান ইউরোপ বাণিজ্য সুবিধা হতে বঞ্চিত হয় এবং অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়। খ্রিস্টানরা এসব বাণিজ্যিক পথ ও
এলাকা দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য পুন:প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
রাজনৈতিক কারণ : ইসলামের আবির্ভাবের পর এর রাজনৈতিক শক্তি পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, স্পেন ও ভূমধ্যসাগরীয়
অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে যেখানে এক সময় খ্রিস্টানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুসলিম সাম্রাজ্যের ক্রমাগত সম্প্রসারণে খ্রিস্টানগণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বিজীত অঞ্চল পুনরুদ্ধার ও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ধর্মযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা করে।
 

 

 


ক্রুসেড আহ্বান : ১০৯৪ সালে সেলজুকগণ অভিযান চালিয়ে বাইজানটাইন রাজধানী কনস্টানটিনোপোলের নিকটবর্তী হলে সম্রাট আলেকসিয়াস কমনেনাস আতঙ্কিত হয়ে পোপের নিকট সাহায্যের আবেদন করেন। পোপ দ্বিতীয় আরবান জেরুজালেমসহ এশিয়া মাইনর পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১০৯৫ সালে ফ্রান্সের ক্লেরমোন্ট শহরে আহূত এক সম্মেলনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করেন। ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের পাপমোচন ও স্বর্গ লাভের আশ্বাস দেয়া হয়।
ক্রুসেডের পর্বসমূহ
১০৯৬ সালে সালে প্রথম ক্রুসেড শুরু হয় এবং সর্বমোট ৮টি পর্বে ক্রুসেড সম্পন্ন হবার পর ১২৯১ সালে পরিসমাপ্তি ঘটে। ধর্মযুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ডের ধর্মযোদ্ধাগণ অংশগ্রহণ করে। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জঙ্গী বংশের ইমামুদ্দিন জঙ্গী ও নুরুদ্দীন জঙ্গী; আইয়্যবী বংশের গাজী সালাহ্উদ্দিন আইয়্যবী, আল-আদিল, আল-কামিল ও মালিক আস-সালিহ; মামলুক বংশের বাইবার্স, কালাউন ও আশরাফ প্রমূখ শাসকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ক্রুসেডের সময় এশিয়া মাইনর, এডেসা, এন্টিয়ক, জাফফা, আক্কা, সিডন, বৈরুত, ত্রিপলি, জেরুজালেম, আলেপ্পো, মসুল, হাররান, হিট্টিন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ক্রুসেডের একটি পর্বে খ্রিস্টান শিশুদেরকেও নিয়ে আসা হয় যারা পরে ইতালির অসাধু খ্রিস্টান বণিকদের মাধ্যমে দাসে পরিণত হয়। প্রায় দুশ বছর ব্যাপী ধর্মযুদ্ধ জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত জেরুজালেমে মুসলিমরা আধিপত্য বহাল রাখতে সক্ষম হয়।
ক্রুসেডের ফলাফল
ক্রুসেডের ফল সুদূর প্রসারী। ক্রুসেডের মাধ্যমে খ্রিস্টানরা জেরুজালেম উদ্ধার করতে না পারলেও ইউরোপের জন্য ক্রুসেড ব্যাপক ইতিবাচক ফলাফল বয়ে নিয়ে এসেছিল। প্রাচ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ : ক্রুসেডের ফলে খ্রিস্টান ইউরোপ প্রাচ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। প্রাচ্যে ব্যবহৃত অনেক দ্রব্য নিজেদের দেশে নিয়ে যাবার সুযোগ পায় যে সম্পর্কে ইতোপূর্বে তাদের কোন ধারণাই ছিলনা। মেরিনার্স কম্পাস,
সুগন্ধি দ্রব্য, উন্নত কার্পেট, উন্নতমানের কৃষি পদ্ধতি, শিল্পজাত দ্রব্যাদি, লাইটিং, মসলা ইত্যাদি দ্রব্যাদি নিজেদের দেশে নিয়ে যাবার কারণে ইউরোপে এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়।
মসলা বাণিজ্য ও ভৌগোলিক আবিস্কার : প্রাচ্যের মসলার ইউরোপে এত চাহিদা ছিল যে ইউরোপীয় বণিকরা প্রাচ্যের সাথে মসলা বাণিজ্য শুরু করে। প্রাচ্যের মসলা বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা আফ্রিকার পশ্চিম
উপকূল ধরে বিকল্প জলপথের আবিস্কার করে। বলা যায় ভৌগোলিক আবিস্কার ক্রুসেডের পরোক্ষ ফল । ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার : ক্রুসেডের ফলে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে রেশারেশির কারণে খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারীরা প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মিশনারী স্থাপনের মাধ্যমে তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ লাভ করে।
রেনেঁসা ও আধুনিক ইউরোপের সৃষ্টি : ইউরোপের রেনেসা বা নবজাগরণ সৃষ্টিতে আরব তথা ইসলামী সংস্কৃতির বিরাট প্রভাব রয়েছে যা ক্রুসেডের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। ক্রুসেডের ফলে আধুনিক ইউরোপের জন্ম হয়। কারণ এর ফলে প্রাচ্যের তথা ইসলামী সভ্যতার অনেক উপাদান ইউরোপীয়রা গ্রহণ করার সুযোগ পায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অনেক আরবী পাণ্ডুলিপি প্রাচ্য হতে সংগ্রহ করে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
সারসংক্ষেপ:
খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধকে ক্রুসেড বলা হয়। ইউরোপের খ্রিস্টানরা মুসলিমদের নিকট থেকে যিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের নামে প্রাচ্যের মুসলিমদের সাথে কথিত ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়। বাইজানটাইন সম্রাট আলেকসিয়াস কমনেনাসের আবেদনের প্রেক্ষিতে পোপ দ্বিতীয় আরবান ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করেন। ১০৯৬ সালে সালে প্রথম ক্রুসেড শুরু হয় এবং সর্বমোট ৮টি পর্বে ক্রুসেড সম্পন্ন হবার পর ১২৯১ সালে পরিসমাপ্তি ঘটে। ক্রুসেডের ফলাফল সুদূর প্রসারী। ইউরোপে রেনেসা ও আধুনিক ইউরোপ সৃষ্টিতে ক্রুসেড ভূমিকা রাখে ।

 

 


পাঠ-১০.৯
আইয়্যবী বংশ
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
■ সালাহ্উদ্দিন আইয়্যবীর পরিচয় দিতে পারবেন;
আইয়্যবী বংশের উত্থানের বিবরণ দিতে পারবেন ও
সালাহ্উদ্দিন আইয়ূবীর রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও ক্রুসেডারদের সাথে সংঘর্ষের বর্ণনা দিতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
নজমুদ্দিন আইয়ূব, কুরুন হামার যুদ্ধ, হিত্তিনের যুদ্ধ, আস্-সালিহ, তুরান শাহ ও শাজারুদ্বার
দ্বাদশ শতকে ইউরোপের ক্রুসেডারদের উপর্যপুরি আঘাতে পশ্চিম এশিয়া হতে ইসলাম যখন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হবার পথে তখন সালাহ্উদ্দিন আইয়্যবী ইসলামের গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর উত্থানের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ফাতিমিদের পতন ঘটে, অন্যদিকে তেমনি আইয়্যবী বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এ বংশের মোট ৮ জন শাসক শাসন করলেও সালাহ্উদ্দিন আইয়্যূবীই ছিলেন এ বংশের শ্রেষ্ঠ ও সফল শাসক।
সালাহ্উদ্দিন আইয়্যবীর পরিচয় : গাজী সালাহ্উদ্দিন আইয়ূবী ১১৩৮ সালে তাইগ্রীস নদীর তীরে তিকরিত নামক স্থানে এক কুর্দি পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পূর্ণ নাম সালাহ্উদ্দিন ইউসূফ বিন আইয়্যূব। ‘সালাহ্উদ্দিন' শব্দের অর্থ ‘সততার প্রতি বিশ্বস্ত’। পিতা-মাতা ছিলেন কুর্দি। পিতা নজমুদ্দিন আইয়ূব ইমামুদ্দিন জঙ্গী কর্তৃক বালাবাক্ক-এর সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। সালাহ্উদ্দিন আইয়্যূবীর বাল্য, কৈশর ও প্রাথমিক দিনগুলি কেটেছে সিরিয়ায়। ১১৬৪ সাল পর্যন্ত জনসমক্ষে তিনি পরিচিতি পাননি। ১১৬৪ সালে চাচা শিরকুহের সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিসরে যেতে বাধ্য হন। এটাই তাঁর প্রথম অভিযান, আর এর মাধ্যমেই তাঁর সৌভাগ্যের সূচনা হয়। এখানে এসে তিনি দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন: ১. শিয়া সম্প্রদায়ের পরিবর্তে সুন্নী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ২. ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে ফ্রাঙ্কদের প্রতিহত করা। বিশেষ করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্য লাভ করে তিনি গাযী উপাধি লাভ করেন এবং পরবর্তী ইতিহাসে তিনি একজন যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
আইয়্যবীয় বংশের উত্থান : ফাতিমি খলিফা আল-আদিদের (১১৬০-৭১) উযির সাওয়ার তুর্কীদের সাহায্যে উযির পদ লাভ করলেও পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কদের সাহায্যে তুর্কিদের সিরিয়ায় তাড়িয়ে দেন। তাদের প্রতিহত করার জন্য বিরাট অংকের অর্থের বিনিময়ে তিনি ফ্রাঙ্কদের মিসরে আহ্বান জানান। কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। স্বয়ং খলিফা ও নগরের অভিজাত রমণীদের আমন্ত্রণে সিরিয়ার নুরুদ্দীন জঙ্গি তাঁর সেনাপতি শিরকুহ এবং সালাহ্উদ্দিনকে ফ্রাংকদের বিতাড়নের জন্য প্রেরণ করেন। ১১৬৯ সালে মিসরে তুর্কী সেনারা বিজয়ীবেশে প্রবেশ করে। সালাহ্উদ্দিন এবং শির্কুহের গতি রোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শিকুকে উযিরের পদে নিয়োগ করা হয়। ২ মাস পরে শিরকুহ্ মৃত্যুমুখে পতিত হলে শিরকুহ্-এর ভাইপো সালাহ্উদ্দিন উযির পদ গ্রহণ করেন। খুতবায় আব্বাসীয় খলিফার নাম পাঠ করা হয়। ১১৭১ সালে সর্বশেষ খলিফা আল-আদিদের মৃত্যু হলে সালাহ্উদ্দিন আব্বাসীয়দের অনুকূলে আইয়্যূবী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ফাতিমি খলিফার নাম বাদ দিয়ে খুতবায় আব্বাসীয় খলিফার নাম পাঠ করা হয়। এই পরিবর্তন ঘটেছিল বিনা প্রতিবাদেই এবং এর ফলে আলোড়ন বা হৈ-চৈ এত কম হয়েছিল যে P. K. Hitti (গ্রন্থ: History of the Arabs) বলেন, “এ নিয়ে দুটো ছাগলেও গুঁতোগুতি হয়নি।” ১১৭৪ সালে নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যু হলে তিনি সমগ্র মিসর, নুবিয়ার কিয়দংশ, হিজায ও ইয়ামেনে স্বাধীনভাবে স্বীয় ক্ষমতা সুদৃঢ় করতে সক্ষম হন এবং কায়রোতে রাজধানী স্থাপন করেন। আর এভাবেই আইয়ূবী বংশের উত্থান হয়। পিতা নজমুদ্দিন আইয়ূবীর নামানুসারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বংশ আইয়্যবী বংশ নামে পরিচিত।
 

 

 

 

 

 

Content added By
Promotion